আমরা জানি, সকল পদার্থই অনু এবং পরমাণু দিয়ে গঠিত। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত 118টি মৌলের 118টি ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু রয়েছে। এদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক মৌলের পরমাণু দিয়েই সকল পদার্থের অণু গঠিত হয়। পদার্থের অণুতে পরমাণুসমূহ এলোমেলো বা বিক্ষিপ্তভাবে থাকে না। পরমাণুসমূহ সুবিন্যস্ততাৰে থাকে। যে আকর্ষণ শাস্তির মাধ্যমে অণুতে দুটি পরমাণু পরস্পর যুদ্ধ থাকে তাকে রাসায়নিক ৰখন বলে। এই ৰখন বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন—আয়নিক বন্ধন, সমযোজী কখন কিংবা খাত বন্ধন। এ অঞ্চায়ে আয়নিক, সমযোর্থী বা ধাতব বন্ধন বিশিষ্ট যৌগের বন্ধন গঠন প্রক্রিয়া ও তাদের ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা -
1 এবং 7 পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট দুইটি মৌল পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে X নামক একটি যৌগ গঠন করে।
কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ কক্ষপথে যে ইলেকট্রন বা ইলেকট্রনসমূহ থাকে তার সংখ্যাকে যোজ্যতা ইলেকট্রন সংখ্যা বলা হয়। যেমন: পটাশিয়াম ও অক্সিজেনের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ কক্ষপথে যথাক্রমে 1টি ও ৪টি করে ইলেকট্রন বিদ্যমান। সুতরাং K এর যোজ্যতা ইলেকট্রন 1টি এবং অক্সিজেনের যোজ্যতা ইলেকট্রন এটি।
নাইট্রোজেন (N) এর K কক্ষপথে ২টি এবং I কক্ষপথে দুটি ইলেকট্রন আছে। নাইট্রোজেনের ক্ষেত্রে L কক্ষপথই হলো সর্বশেষ কক্ষপথ। যেহেতু সর্বশেষ কক্ষপথে দুটি ইলেকট্রন আছে। সুতরাং নাইট্রোজেনের যোজ্যতা ইলেকট্রন আছে দুটি।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভিন্ন মৌলের পরমাণুসমূহ একে অপরের সাথে সর্বশেষ কক্ষপথের ইলেকট্রন বর্জন, গ্রহণ অথবা ভাগাভাগির মাধ্যমে অণু গঠন করে। অণু গঠনকালে কোনো মৌলের একটি পরমাণুর সাথে অপর একটি মৌলের পরমাণু যুক্ত হওয়ার ক্ষমতাকে যোজনী বা যোজ্যতা বলা হয়।
সাধারণত সব সময় হাইড্রোজেনের যোজনী এক (1) ধরা হয়। কোনো মৌলের একটি পরমাণু যতগুলো H পরমাণু বা Cl পরমাণুর সাথে যুক্ত হতে পারে সেই সংখ্যাই হলো ঐ মৌলের যোজনী বা যোজ্যতা।
হাইড্রোজেনের একটি পরমাণু ক্লোরিনের একটি পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে HCl অণু গঠিত হয়, তাই ক্লোরিনের যোজনীও 1 (এক)। আবার অক্সিজেনের একটি পরমাণু হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে H2O তৈরি করে, এজন্য অক্সিজেনের যোজনী 2 (দুই)। একটি Na পরমাণু একটি C1 পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে Nacl গঠিত হয়। সুতরাং Na এর যোজনী 1 (এক)।
একটি পরমাণুর সাথে যতটি অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হয় তার সেই সংখ্যার দ্বিগুণ করলে ঐ পরমাণুর যোজনী বা যোজ্যতা হয়। যেমন : ক্যালসিয়াম (Ca) এর একটি পরমাণু একটি অক্সিজেন (O) পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে ক্যালসিয়াম অক্সাইড (CaO) তৈরি করে। এখানে অক্সিজেন পরমাণুর সংখ্যা 1 এই সংখ্যাকে 2 দ্বারা গুণ করলে হয় 2। কাজেই ক্যালসিয়ামের যোজনী 2 ।
কিছু কিছু মৌলের একাধিক যোজনী থাকে। কোনো মৌলের একাধিক যোজনী থাকলে সেই মৌলের যোজনীকে পরিবর্তনশীল যোজনী বলা হয়। যেমন: Fe এর পরিবর্তনশীল যোজনী 2 এবং 3 ।
কোনো মৌলের সর্বোচ্চ যোজনী এবং সক্রিয় যোজনীর পার্থক্যকে ঐ মৌলের সুপ্ত যোজনী বলা হয়। যেমন: FeCl2 যৌগে Fe এর সক্রিয় যোজনী 2 কিন্তু Fe এর সর্বোচ্চ যোজনী ও অভএব FeCl2 যৌগে Fe এর সুপ্ত যোজনী 3 - 2-1। আবার FeCl, যৌগে Fe এর সক্রিয় যোজনী ও কিন্তু Fe এর সর্বোচ্চ 3 যোজনী 3, অতএব FeCl, যৌগে Fe এর সুপ্ত যোজনী 3 - 3=0 ।
একাধিক মৌলের কতিপয় পরমাণু বা আয়ন পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট একটি পরমাণুগুচ্ছ তৈরি করে এবং এটি একটি মৌলের আয়নের ন্যায় আচরণ করে। এ ধরনের পরমাণুগুচ্ছকে যৌগমূলক বলা হয়।
যৌগমূলক ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট হতে পারে। এদের আধান সংখ্যাই মূলত এদের যোজনী নির্দেশ করে। যেমন: একটি N পরমাণুর সাথে তিনটি H পরমাণু ও একটি H+ যুক্ত হয়ে অ্যামোনিয়াম (NH +) আয়ন নামক যৌগমূলকের সৃষ্টি করে। এর আধান সংখ্যা হলো +1 (এক)। সূতরাং এর যোজনীও 1 (এক)। আধান বা চার্জ ধনাত্মক বা ঋণাত্মক হতে পারে কিন্তু যোজনী শুধু একটি সংখ্যা এর কোনো ধনাত্মক চিহ্ন বা ঋণাত্মক চিহ্ন নেই।
যৌগের একটি অণুতে যেসব পরমাণু থাকে তাদের প্রতীক ও সংখ্যার মাধ্যমে অণুটিকে প্রকাশ করা হয়। যেমন: দুটি হাইড্রোজেন (H) পরমাণু ও একটি অক্সিজেন (O) পরমাণু মিলে পানির (H2O) একটি অণু গঠিত হয়। এখানে, H2O হলো পানির অণুর রাসায়নিক সংকেত। সুতরাং মৌল বা যৌগমূলকের প্রতীক বা সংকেত ও তাদের সংখ্যার মাধ্যমে কোনো যৌগ অণুকে প্রকাশ করাই হলো উক্ত যৌগের রাসায়নিক সংকেত (Chemical Formula)। এক্ষেত্রে অণুর মধ্যে অবস্থিত মৌলের বা যৌগমূলকের সংখ্যাকে সংকেতের নিচে ডান পাশে ছোট করে (Subscript) লেখা হয়।
রাসায়নিক সংকেত লেখার নিয়ম
(a) কোনো মৌলের একটি অণুতে যতগুলো পরমাণু থাকে তার সংখ্যাটি ইংরেজি হরফে মৌলটির প্রতীকের ডান পাশে নিচে ছোট করে লিখতে হবে। যেমন: নাইট্রোজেন অণুতে দুটি পরমাণু থাকে তাই নাইট্রোজেন অণুর সংকেত N2। ওজোন এর একটি অণুতে তিনটি অক্সিজেন পরমাণু থাকে—তাই ওজোন অণুর সংকেত Oz। কিছু মৌল অণু গঠন করে না তাই তাদেরকে শুধু প্রতীক দিয়ে বোঝানো হয়। যেমন: সকল ধাতু। কাজেই আয়রনকে বোঝাতে শুধু Fe লিখতে হবে। আবার, নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোও অণু গঠন করে না, তাই হিলিয়ামকে বোঝাতেও শুধু He লিখতে হবে।
(b) কখনো কখনো কোনো যৌগের অণু দুটি ভিন্ন মৌলের পরমাণু দিয়ে গঠিত হয়। তাদের যোজনী যদি কোনো সাধারণ সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য না হয় তাহলে দুটি মৌলের প্রতীক পাশাপাশি লিখে একটি মৌলের প্রতীকের পাশে অন্যটির যোজনী লিখতে হয়। যেমন: অ্যালুমিনিয়ামের যোজনী 3 এবং অক্সিজেন এর যোজনী 2। যোজনী দুটি কোনো সাধারণ সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য নয়। যদি অ্যালুমিনিয়াম এবং অক্সিজেন দ্বারা গঠিত কোনো যৌগের সংকেত লিখতে হয় তবে অ্যালুমিনিয়ামের প্রতীক Al এর নিচের দিকে ডান পাশে অক্সিজেনের যোজনী ছোট করে লিখতে হবে এবং অক্সিজেনের প্রতীক ০ এর নিচের দিকে ডান পাশে অ্যালুমিনিয়ামের যোজনী ছোট করে লিখতে হবে অর্থাৎ এর সংকেত হবে Al2O3। অনুরূপভাবে ক্যালসিয়ামের যোজনী 2 এবং ক্লোরিনের যোজনী 1। সুতরাং ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডের সংকেত CaCl2 হওয়ার কথা, 1টি লিখতে হয় না বলে আমরা লিখি CaCl2। আবার, ম্যাগনেসিয়ামের যোজনী 2 এবং ফসফেটের যোজনী 3। সুতরাং ম্যাগনেসিয়াম ফসফেটের সংকেত Mg3(PO4)2। উল্লেখ্য যে, কোনো যৌগমূলক একাধিক সংখ্যক থাকলে যৌগমূলকটিকে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে রেখে তারপর সংখ্যা লিখতে হয়। যেমন: অ্যামোনিয়াম ফসফেট (NH4)3 (PO4)1 বা (NH4) 3 PO4, অ্যালুমিনিয়াম সালফেট Al2(SO4)3 ইত্যাদি।
(c) যদি দুটি মৌলের যোজনী কোনো সাধারণ সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য হয় তাহলে যোজনীগুলো সেই সাধারণ সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিয়ে মৌলের পাশে পূর্বের নিয়মে ভাগফলটি লিখতে হয় যেমন: কার্বন ও অক্সিজেন দিয়ে গঠিত যৌগ কার্বন ডাই-অক্সাইড। কার্বনের যোজনী 4 এবং অক্সিজেনের যোজনী 2 কার্বনের যোজনীকে 2 দিয়ে ভাগ করলে 2 পাওয়া যায় আবার অক্সিজেনের যোজনীকে 2 দিয়ে ভাগ করলে 1 পাওয়া যায়। এখন প্রথম নিয়মের অনুযায়ী কার্বনের সংকেত C এর নিচে ডান পাশে 1 এবং অক্সিজেনের নিচে 2 লিখতে হবে। কিন্তু সংকেত লেখার সময় যেহেতু 1 সংখ্যাটি লেখার প্রয়োজন নেই তাই কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংকেত হবে CO2 I ফেরাস সালফেট যৌগে আয়রনের যোজনী 2 সালফেট আয়নের (SO22) যোজনী 2। এই সংখ্যা দুটিকে 2 দিয়ে ভাগ করে 1 ও 1 পাওয়া যায়। সুতরাং ফেরাস সালফেটের সংকেত FeSO4 । বোরন ও নাইট্রোজেনের যোজনী 3 । এদের ও দিয়ে ভাগ করলে 1 ও 1 পাওয়া যায় সুতরাং বোরন নাইট্রাইডের সংকেত B1N1=BN
একটি মৌল বা যৌগের অণুতে যে যে ধরনের মৌলের পরমাণু থাকে তাদের প্রতীক এবং যে মৌলের পরমাণু যতটি থাকে সেই সকল সংখ্যা দিয়ে প্রকাশিত সংকেতকে আণবিক সংকেত বা রাসায়নিক সংকেত বলে। এ সম্পর্কে তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছো। আবার একটি অণুতে মৌলের পরমাণুগুলো যেভাবে সাজানো থাকে প্রতীক এবং বন্ধনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করাকে গাঠনিক সংকেত বলে। যেমন তিনটি কার্বন (C) পরমাণু আটটি হাইড্রোজেন (H) পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে প্রোপেন (C3Hg) অণু গঠিত হয়। প্রোপেনের C3Hg এই সংকেতটিকে আণবিক সংকেত বা রাসায়নিক সংকেত বলে।
আবার উক্ত যৌগে কার্বন পরমাণু তিনটি একে অপরের সাথে শিকল আকারে যুক্ত হয় এবং অবশিষ্ট যোজনীগুলো হাইড্রোজেন দ্বারা পূর্ণ হয়ে প্রতিটি কাবর্নের যোজনী 4 হয়। নিচের চিত্রে প্রোপেনের গাঠনিক সংকেত দেখানো হলো:
H H H
H-C-C-C-H
H H H
আবার পানির আণবিক সংকেত H,O, অতএব এর গাঠনিক সংকেত হবে
O
H H
মিথেনের আণবিক সংকেত CH4, অতএব মিথেনের গাঠনিক সংকেত হবে
H
H-C-H
H
কার্বন-কার্বন ও কার্বন-হাইড্রোজেনের মধ্যে অবস্থিত প্রতিটি রেখা হলো একেকটি বন্ধন। এগুলো সমযোজী বন্ধন। সমযোজী বন্ধন সম্পর্কে এ অধ্যায়েই জানতে পারবে। গাঠনিক সংকেতের মাধ্যমে যৌগের অণুতে কোন পরমাণু কতটি করে আছে এবং তারা একে অপরের সাথে কীভাবে যুক্ত আছে তা জানা যায় ।
প্রতিটি মৌলই তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে নিষ্ক্রিয় প্যানের ইলেকট্রন বিন্যাসের প্রবণতা দেখায়। হিলিয়াম ছাড়া সকল নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি করে ইলেকট্রন বিদ্যমান। অণু গঠনকালে কোনো মৌল ইলেকট্রন গ্রহণ, বৰ্জন অথবা ভাগাভাগির মাধ্যমে তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি করে ইলেকট্রন ধারণের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করে। একেই 'অষ্টক' নিয়ম বলা হয়। যেমন: CH, অনুতে কেন্দ্রীয় পরমাণু কার্বনের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন বিদ্যমান। যেখানে এটি ইলেকট্রন কার্বনের নিজস্ব আর বাকি এটি ইলেকট্রন চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে আসে। পাশের চিত্রে তা দেখানো হলো। এভাবে পরমাণুসমূহ তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন ধারণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভের মাধ্যমে যৌগ গঠনের পদ্ধতিকে 'অষ্টক' নিয়ম বলে।
'অষ্টক' নিয়মের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে বিজ্ঞানীরা নতুন একটি নিয়মের উপস্থাপন করেন। যাকে 'দুই' এর নিয়ম বলা হয়। 'দুই' এর নিয়মটি অষ্টক নিয়ম থেকে অধিকতরউপযোগী এবং আধুনিক। নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর চিত্র 5.02: মিথেন অণুতে অণ্টক নিয়ম।
সর্বশেষ শক্তিস্তরে যেমন 2টি বা ৪টি ইলেকট্রন বিদ্যমান, তেমনি অণু গঠনে কোনো পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে এক বা একাধিক জোড়া ইলেকট্রন বিদ্যমান থাকবে, এটিই হচ্ছে 'দুই' এর নিয়ম। অর্থাৎ অণুতে যেকোনো পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে এক বা একাধিক জোড়া ইলেকট্রন অবস্থান করবে।
যেমন: BeCl2 অণুর কেন্দ্রীয় পরমাণু Be এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে 2 জোড়া অর্থাৎ এটি ইলেকট্রন বিদ্যমান। BF; অণুর কেন্দ্রীয় পরমাণু B এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে ও জোড়া অর্থাৎ এটি ইলেকট্রন বিদ্যমান। CH4 অণুর কেন্দ্রীর পরমাণু C এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে 4 জোড়া অর্থাৎ ৪টি ইলেকট্রন বিদ্যমান। শুধু তাই নয় কেন্দ্রীয় পরমাণু ছাড়াও অন্য পরমাণুগুলো অর্থাৎ Cl এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে 4 জোড়া অর্থাৎ ৪টি ইলেকট্রন বিদ্যমান।
F সর্বশেষ শক্তিস্তরে 4 জোড়া অর্থাৎ ৪টি ইলেকট্রন বিদ্যমান এবং H এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে 1 জোড়া অর্থাৎ 2টি ইলেকট্রন বিদ্যমান। এক্ষেত্রে সকল পরমাণু ‘দুই' এর নিয়ম অনুসরণ করেছে। উল্লেখ্য, পর্যায় সারণির 1-20 পর্যন্ত মৌলসমূহ মূলত ‘অষ্টক’ ও ‘দুই’ এর নিয়ম ভালোভাবে অনুসরণ করে।
পর্যায় সারণি অধ্যায়ে তোমরা নিষ্ক্রিয় গ্যাস তথা 18 নং গ্রুপের মৌল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছো। এদের ইলেকট্রন বিন্যাস সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করেছো। তারপরও এখানে এদের ইলেকট্রন বিন্যাস দেখানো হলো:
He (2) ⇒ 1s2
Ne (10) 1s 2 2s 2 2p 6
Ar(18) ⇒ 1s2 2s22p 6 3s 2 3p 6
Kr(36) ⇒ 1s2 2s2 2p 6 3s 2 3p 3d10 4s 2 4p 6
Xe(54) ⇒ 1s2 2s 2 2p 6 3s 2 3p 3d10 4s 2 4p 4d 15s 5p6
Rn(86) → 1s2 2s2 2p6 3s 2 3p 3d10 4s 2 4p 4d 4f145s 5p 5d106s 6p6
নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহের ইলেকট্রন বিন্যাসে দেখা যায় যে, হিলিয়ামের সর্বশেষ শক্তিস্তরে 2টি ইলেকট্রন রয়েছে। হিলিয়ামের বেলায় তার সর্বশেষ শক্তিস্তর পূর্ণ করতে 2টি ইলেকট্রনই প্রয়োজন, কাজেই এই ইলেকট্রন বিন্যাস স্থিতিশীল। অন্যান্য নিষ্ক্রিয় গ্যাসের বেলায় তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি (ns np ) করে ইলেকট্রন বিদ্যমান। কোনো মৌলের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি করে ইলেকট্রন থাকলে তারা সর্বাধিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে। সর্বশেষ শক্তিস্তরে 2টি থাকলে তাকে দ্বিত্ব বলে আর ৪টি ইলেকট্রন থাকলে তাকে অষ্টক বলে। সর্বশেষ শক্তিস্তরে দ্বিত্ব ও অষ্টক পূর্ণ থাকার কারণে নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো অধিকতর স্থিতিশীল হয়। অধিকতর স্থিতিশীলতার কারণে নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো অন্য কোনো মৌলকে ইলেকট্রন প্রদান করে না। এমনকি অপর কোনো মৌলের কাছ থেকে কোনো ইলেকট্রন গ্রহণও করে না। এরা রাসায়নিকভাবে আসক্তিহীন হয়ে পড়ে বা এরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। নিষ্ক্রিয় গ্যাস ছাড়া বাকি কোনো মৌলেরই সর্বশেষ শক্তিস্তরে এরূপ দ্বিত্ব বা অষ্টক পূর্ণ থাকে না। ফলে তারা স্থিতিশীল হয় না। অন্যান্য মৌল স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য সর্বশেষ শক্তিস্তরে দ্বিত্ব বা অষ্টক পূরণ করতে চায়। এজন্য তারা সর্বশেষ শক্তিস্তরে ইলেকট্রন গ্রহণ, প্রদান অথবা ভাগাভাগি করে পরস্পরের সাথে বন্ধন গঠন করে।
দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন অণু (H2) গঠন করে। অনুরূপভাবে, হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন পরমাণু পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড অণু (H-Cl) গঠন করে। প্রথম ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন অণুতে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ বল কাজ করে। আবার, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড অণুতে হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন পরমাণুর মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ বল কাজ করে। এ ধরনের আকর্ষণ বলই মূলত রাসায়নিক বন্ধন। অর্থাৎ অণুতে পরমাণুসমূহ যে আকর্ষণের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে তাকেই রাসায়নিক বন্ধন বলে। এখন প্রশ্ন হলো পরমাণুসমূহ কেন আলাদাভাবে থাকেনি? কেন তারা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে অণু তৈরি করল?
তোমরা এর মাঝে জেনে গেছো যে, প্রত্যেক মৌলই তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের স্থিতিশীল ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জনের চেষ্টা করে। একই মৌলের বা ভিন্ন মৌলের দুটি পরমাণু যখন কাছাকাছি অবস্থান করে তখন তারা তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে ইলেকট্রন গ্রহণ, বর্জন বা ভাগাভাগির মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে। এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণের সৃষ্টি হয়, যে আকর্ষণকে আমরা রাসায়নিক বন্ধন বলি। কাজেই বলা যেতে পারে রাসায়নিক বন্ধন গঠনের মূল কারণ হলো পরমাণুগুলোর সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনগুলো নিষ্ক্রিয় গ্যাসের স্থিতিশীল ইলেকট্রন বিন্যাস (দ্বিত্ব বা অষ্টক) লাভের প্রবণতা ।
আমরা জানি, সাধারণ অবস্থায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যতটি ধনাত্মক আধান বা পজিটিভ চার্জবিশিষ্ট প্রোটন থাকে এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে বিভিন্ন শক্তিস্তরে ঠিক ততটি ঋণাত্মক আধান বা নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রন থাকে। এর ফলে পরমাণুটি সামগ্রিকভাবে আধান বা চার্জ নিরপেক্ষ হয়। এরকম একটি আধান নিরপেক্ষ পরমাণুর বাইরের শক্তিস্তর থেকে এক বা একাধিক ইলেকট্রনকে সরিয়ে নিলে পরমাণুটি আর আধান নিরপেক্ষ থাকবে না। এটি সামগ্রিকভাবে ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট আয়নে পরিণত হবে। ধনাত্মক আধান বা পজিটিভ চার্জ বিশিষ্ট এরূপ আয়নকে ক্যাটায়ন বলে। সাধারণত পর্যায় সারণির বামের মৌল বা ধাতুগুলো তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভের মাধ্যমে ক্যাটায়নের সৃষ্টি করে। যেমন: লিথিয়াম পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের একটি ইলেকট্রন ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়ামের ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জনের মাধ্যমে লিথিয়াম ক্যাটায়ন (Li+) তৈরি করে।
অনুরূপে, Na পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাস Ne এর ইলেকট্রন বিন্যাস লাভের মাধ্যমে সোডিয়াম ক্যাটায়ন (Na+) তৈরি করে।
বলতে পারবে কি, ধাতুসমূহ কেন তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন ছেড়ে দিয়ে ক্যাটায়ন তৈরি করে?
আমরা জানি, পর্যায় সারণির যেকোনো একটি পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে মৌলসমূহের ধাতব ধর্ম ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং অধাতব ধর্ম বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ যেকোনো পর্যায়ের বামের মৌলসমূহ হলো ধাতু এবং ডালের মৌলসমূহ হলো অধাতু। আবার একই পর্যায়ে ৰাম থেকে ডানে গেলে মৌলসমূহ আকারও ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। এই কারণে একই পর্যায়ে অবস্থিত অন্য মৌলসমূহের চেয়ে ধাতুগুলোর আকার বড় হয়ে থাকে। আবার ধাতুগুলোর সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাধারণত 1, 2 বা 3টি ইলেকট্রন থাকে। আকার বড় হওয়ার কারণে ধাতুগুলোর সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনগুলোর নিউক্লিয়াস থেকে দূরে থাকে এবং নিউক্লিয়াসের সাথে আকর্ষণ কম হয় অর্থাৎ দুর্বলভাবে আবদ্ধ থাকে। ফলে এদের আরনিকরণ শন্তির মান অনেক কম হয়। অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করলেই ধাতুগুলো তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করে কাছাকাছি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে ক্যাটায়নে পরিণত হতে পারে। এই কারণেই ধাতুগুলোই মূলত ক্যাটায়নে পরিণত হয়।
অন্যদিকে অধাতুগুলো ক্যাটায়ন তৈরি করে না। এর কারণও তোমরা এখন নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো। অধাতুগুলো পর্যায় সারণির ডানে অবস্থান করে। এদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাধারণত 5, 6 বা 7টি ইলেকট্রন বিদ্যমান থাকে। এদের আকার একই পর্যায়ের ধাতুসমূহের চেয়ে অনেক ছোট হয়। ছোট আকারের কারণে সর্বশেষ শক্তিস্তর নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি থাকে এবং এদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনের প্রতি নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ অনেক বেশি হয়, অর্থাৎ এদের আয়নিকরণ শক্তির মান অনেক বেশি হয়। এরূপ কোনো মৌলের সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রনকে সরিয়ে নিতে অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়, যা সাধারণ অবস্থায় কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে সহজে পাওয়া যায় না। এ কারণে অধাতুগুলো সাধারণত ধনাত্মক আধান তথা ক্যাটায়ন তৈরি করে না।
তাহলে কি অধাতুগুলো তার সর্বশেষ শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের কোনো পরিবর্তন ঘটায় না? অবশ্যই ঘটায় । যেহেতু এদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে অষ্টক অপেক্ষা সাধারণত 1, 2 কিংবা এটি ইলেকট্রন কম থাকে সেহেতু এরা সেই সংখ্যক ইলেকট্রন গ্রহণ করে সহজেই নিষ্ক্রিয় গ্যাসের স্থিতিশীল ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করে। অন্যভাবে বলা যায়, এদের ইলেকট্রন আসন্তির মান বেশি। ইলেকট্রন গ্রহণের ফলে এদের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক প্রোটন সংখ্যার চেয়ে ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে অধাতব পরমাণুসমূহ ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট হয়। এভাবে ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট অধাতব পরমাণুকে অ্যানায়ন বলে। যেমন ক্লোরিন (Cl) পরমাণু একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাস আর্গনের (Ar) ইলেকট্রন বিন্যাস লাভের মাধ্যমে ক্লোরাইড (Cl-) আয়ন তৈরি করে।
আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি যে, ধাতুগুলোর আয়নিকরণ শক্তির মান অনেক কম হওয়ায় এরা অতি সহজেই সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট আয়ন বা ক্যাটায়নে পরিণত হয়। আবার অধাতুগুলোর ইলেকট্রন আসক্তির মান বেশি হওয়ায় এরা সহজেই সর্বশেষ শক্তিস্তরে এক বা একাধিক ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট আয়ন বা অ্যানায়নে পরিণত হয়। এভাবে সৃষ্ট বিপরীত আধানের ক্যাটায়ন ও অ্যানারনের মধ্যে স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বল বা ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বল কাজ করে। এই ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বল বা কুলম্ব আকর্ষণ বল এর ফলে তারা একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে। যে আকর্ষণের ফলে ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে সেটিই আয়নিক বা তড়িৎযোজী বন্ধন। যেমন Na পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে Nat ক্যাটায়নে পরিণত হয়। অপরদিকে Cl পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের Na এর ত্যাগকৃত ইলেকট্রনটিকে গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে C1- অ্যানায়নে পরিণত হয়। এভাবে সৃষ্ট ধনাত্মক আধান Na+ ও ঋণাত্মক আধান Cl- পরস্পরের সাথে স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণে আবদ্ধ হয়। এই আকর্ষণ বলই আয়নিক বন্ধন। অর্থাৎ ধাতব ও অধাতব পরমাণুর রাসায়নিক সংযোগের সময় ধাতব পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রনকে অধাতব পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে স্থানাঙ্কর করে ধনাত্মক ঋণাত্মক আয়ন সৃষ্টির মাধ্যমে যে বন্ধন গঠিত হয় তাকে আয়নিক বা তড়িৎযোজী বন্ধন বলে। যে যৌগে আয়নিক বন্ধন থাকে তাকে আয়নিক যৌগ বলে।
Na → Na+ +e
Cl +e- → Cl-
Na + Cl → Na+ + Cl- = NaCl
MgO অণুতে Mg 2টি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় প্যাস Ne এর মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে Mg2+ এ পরিণত হয়
Mg → Mg2+ + 2e-
আবার O পরমাণু ঐ ২টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাস Ne এর মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে O2- এ পরিণত হয়।
O + ze- → Oz-
এবার Mg2+ এবং O+ কাছাকাছি এসে আয়নিক বন্ধন তৈরি করে। যে যৌগে আয়নিক বন্ধন বিদ্যমান সেই যৌগকে আয়নিক যৌগ বলে। যেমন: MgO একটি আয়নিক যৌগ।
NaH অণুতে Na পরমাণু ইলেকট্রন দান করে নিস্ক্রিয় গ্যাসের মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে Na+ এ পরিণত হয় এবং H পরমাণু ঐ ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ২টি ইলেকট্রন গঠন করে H-এ পরিণত হয়। অতঃপর এদের মধ্যে আয়নিক বন্ধন গঠিত হয়।
Na → Na++ e-
H + e- → H-
CaO অণুতে Ca পরমাণু এটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে Ca2+ তে পরিণত হয়।
Ca → Ca2+ + 2e-
O পরমাণু সেই ২টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে 2-এ পরিণত হয়
0 + 2e- → O2-
অতএব Ca2+ এবং O2- এর মধ্যে আয়নিক বন্ধন গঠিত হয়।
উপরের উদাহরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ধাতুগুলো ইলেকট্রন বর্জন এবং অধাতুগুলো ধাতু কর্তৃক বর্জন করা ইলেকট্রন গ্রহণ করে যথাক্রমে ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নে পরিণত হয়। এই ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন পরস্পরের কাছাকাছি আবদ্ধ হয়ে আয়নিক বন্ধন তৈরি করে। উল্লেখ্য, পর্যায় সারণির 12 নম্বর গ্রুপের ধাতব মৌলসমূহ এবং 16 ও 17 নম্বর গ্রুপের অধাতব মৌলসমূহ সাধারণত আয়নিক বন্ধন তৈরি করে। প্রত্যেকটি নিয়মের কিছু না কিছু ব্যতিক্রম থাকে। যেমন এখানে 13 নম্বর গ্রুপের Al মৌলটি 1 ও 2 নম্বর গ্রুপের মৌল না হওয়া সত্ত্বেও আয়নিক বন্ধন তৈরি করে। অন্য মৌলসমূহ তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে অনেক বেশি ইলেকট্রন ধারণ করার কারণে তারা ইলেকট্রন বর্জন বা গ্রহণ করার প্রবণতা দেখায় না। ফলে তারা আয়নিক বন্ধনও তৈরি করে না। আয়নিক বন্ধন স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণের মাধ্যমে ঘটে বলে এ বন্ধন খুবই শক্তিশালী হয়।
তোমরা ইতোপূর্বে জেনেছো যে, একটি ধাতব পরমাণু ও একটি অধাতব পরমাণু রাসায়নিক সংযোগের সময় ধাতু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন অধাতব পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে স্থানান্তর করে ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন তৈরির মাধ্যমে আয়নিক বন্ধনের সৃষ্টি করে। কিন্তু তুমি যদি দুটি অধাতব পরমাণুর মধ্যে রাসায়নিক সংযোগ করাতে চাও তাহলে সেটি কীভাবে ঘটবে? অধাতুর বেলায় পরমাণুর শেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন ত্যাগ বা গ্রহণ করা সহজ নয় বলে তাদের ভেতর বন্ধন তৈরি করা কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দুটি অধাতব পরমাণু বন্ধন গঠন করে। যেমন: দুটি ক্লোরিন (অধাতু) পরমাণুকে যখন কাছাকাছি রাখা হয় তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক বন্ধন গঠিত হয়ে ক্লোরিন অণুতে পরিণত হয়। প্রশ্ন হলো কীভাবে দুটি অধাতব ক্লোরিন পরমাণু একে অপরের সাথে বন্ধন তৈরি করে? এদের তো সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাতটি করে ইলেকট্রন আছে।
ক্লোরিনের ইলেকট্রন বিন্যাস হলো: C1 (17) 1s2 2s2 2p6 3s2 3p5
Cl এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাতটি ইলেকট্রন থাকায় ক্লোরিন পরমাণু সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন প্রদান করতে চাইবে না বরং গ্রহণের প্রবণতা দেখাবে। কিন্তু দাতা পরমাণু না থাকায় গ্রহণ প্রক্রিয়াও ঘটবে না। তাই দুটি ক্লোরিন পরমাণু কাছাকাছি এলে প্রত্যেকটি পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তর থেকে 1টি করে ইলেকট্রন এসে জোড়বদ্ধ হয় এবং ঐ ইলেকট্রন জোড় উভয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মাঝামাঝি অবস্থান করে। একে ইলেকট্রনের ভাগাভাগি বা ইলেকট্রনের শেয়ারিং বলে। এর ফলে উভয় পরমাণু তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে আটটি করে ইলেকট্রন লাভ করে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করে। ফলস্বরূপ দুটি ক্লোরিন পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে না অর্থাৎ এরা এক ধরনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ ধরনের বন্ধনকে সমযোজী বন্ধন বলে। অর্থাৎ দুটি অধাতব পরমাণুর রাসায়নিক সংযোগের সময় অধাতব পরমাণুদ্বয় তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের (এক বা একাধিক) একটি ইলেকট্রনকে সরবরাহ করে এক জোড়া ইলেকট্রন তৈরি করে। এরপর এই এক জোড়া ইলেকট্রন উভয় পরমাণু শেয়ারের মাধ্যমে যে বন্ধন গঠিত হয় তাকে সমযোজী বন্ধন বলে। যে যৌগে সমযোজী বন্ধন থাকে তাকে সমযোজী যৌগ বলে। প্রতিটি সমযোজী বন্ধনে দুটি ইলেকট্রন অংশগ্রহণ করে। সমযোজী বন্ধনকে একটি রেখার (-) মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় এবং ইলেকট্রনসমূহকে ডট (.) চিহ্ন বা ব্রুস (X) চিহ্ন দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
ক্লোরিন অণুতে দুটি ক্লোরিন পরমাণু বিদ্যমান। ক্লোরিন অণুর সংকেত হলো Cl2 | অনেক অধাতু অণু আকারে থাকে। যেমন: হাইড্রোজেন (H2), অক্সিজেন (O2), নাইট্রোজেন (N2), সালফার (Sg), ফসফরাস (P4), ব্রোমিন (Br2), আয়োডিন ( I2 ), ফ্লোরিন (F2 ) ইত্যাদি।
H, অণুতে সমযোজী বন্ধন: হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস হলো, H ( 1 ) = 1s । দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু যখন কাছাকাছি আসে তখন উভয় পরমাণুই একটি করে ইলেকট্রন শেয়ার করে নিষ্ক্রিয় প্যাসের মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ২টি ইলেকট্রন গঠন করে। এর ফলে (H - H) সমযোজী বন্ধনের সৃষ্টি হয়।
O2 অণুতে সমযোজী বন্ধন: অক্সিজেন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস হলো, O(8) = 1s2 2s2 2p4 অক্সিজেন পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস (অষ্টক) অপেক্ষা দুটি ইলেকট্রন কম আছে। এরূপ দুটি অক্সিজেন পরমাণু কাছাকাছি এলে তাদের উভয় পরমাণুই নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪টি ইলেকট্রন গঠন করে। ফলে তাদের মধ্যে (O2) সমযোজী বন্ধন গঠিত হয়। এক্ষেত্রে উভয় পরমাণু দুটি করে মোট চারটি ইলেকট্রন শেয়ার করায় সমযোজী বন্ধনের সংখ্যা হয় 2 (দুই)। যেমন:
সাধারণভাবে,
0+0 - 0=0 বা O2
এতক্ষণ আমরা একই অধাতব পরমাণু দ্বারা গঠিত অণু তথা মৌলিক অণুসমূহের মধ্যে সমযোজী বন্ধন দেখলাম। মৌলিক অপু ছাড়াও একাধিক ভিন্ন অধাতব পরমাণু দ্বারা গঠিত যৌগিক অণুতেও সমযোজী বন্ধন দেখতে পাওয়া যায়। যেমন: পানির অণুতে অক্সিজেন পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের একটি করে ইলেকট্রন প্রত্যেক হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি করে ইলেকট্রনের সাথে শেয়ার করে। এভাবে দুটি (O-H) সমযোজী বন্ধন গঠনের মাধ্যমে পানির অণু গঠিত হয়।
H2O অণুতে পরমাণুর 2 জোড়া ইলেকট্রন অর্থাৎ এটি ইলেকট্রন এখানে কোনো বন্ধন গঠন করেনি। কিন্তু প্রয়োজন হলে এই চারটি ইলেকট্রন কখন গঠন করতে পারে এই বিষয়গুলো তোমরা উচ্চতর শ্রেণিতে জানতে পারবে। O পরমাণু সমযোজী এবং আয়নিক উভয় প্রকার যৌগ গঠন করলেও Na পরমাণু কখনোই সমযোজী যৌগ গঠন করে না। Na পরমাণু সব সময় আয়নিক যৌগ গঠন করে। কারণ হিসেবে বলা যায়, 0 পরমাণু কোনো মৌল থেকে ২টি ইলেকট্রন গ্রহণ করেও ঐ মৌলের সাথে আয়নিক বন্ধন তৈরি করে আবার কোনো মৌলের সাথে ২টি ইলেকট্রন শেয়ার করেও ঐ মৌলের সাথে সমযোজী বন্ধন তৈরি করতে পারে। Na. পরমাণু সব সময় ইলেকট্রন ত্যাগ করে কোনো মৌলের সাথে আয়নিক বন্ধন তৈরি করে। কিন্তু Na পরমাণু কোনো মৌলের সাথেই ইলেকট্রন শেয়ার করে সমযোজী বন্ধন তৈরি করে না। সমযোজী বন্ধনবিশিষ্ট মৌলিক পদার্থের অণুকে (যেমন: N2, O2, Cl2, Br2 l2) সমযোজী অণু এবং সমযোজী বন্ধনবিশিষ্ট যৌগকে সমযোজী যৌগ অণু বলা হয় (যেমন: CH4, CO2, HCl, NH3, ইত্যাদি)।
অনেক সমযোজী অণু স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। যেমন: CO2, NH3, O2, N2, Cl2 ইত্যাদি। আবার কিছু সমযোজী অণু স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে তরল অবস্থায় বিরাজ করে। যেমন: H2O (পানি), C2H5OH (ইথানল) ইত্যাদি এবং কিছু কঠিন অবস্থায় থাকে, যেমন: ন্যাপথালিন (C1oHg), সালফার (Sg), আয়োডিন (I2) ইত্যাদি। দুটি সমযোজী অণু যখন খুবই নিকটবর্তী হয় তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের দুর্বল আকর্ষণ বল কাজ করে, এই আকর্ষণ বলকেই ভ্যান্ডারওয়ালস আকর্ষণ বল বলে। সমযোজী অণুগুলো পরস্পরের সাথে এই দুর্বল ভ্যান্ডারওয়ালস আকর্ষণের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। তাই এদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে সামান্য শক্তির প্রয়োজন হয়। ফলে এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অনেক কম হয়। আবার গ্যাসীয় সমযোজী অণুর মধ্যে (যেমন: CO2, NH3, O2 ইত্যাদি) ভ্যান্ডারওয়ালস আকর্ষণ বল নেই বললেই চলে, যার কারণে এরা একক অণু হিসেবে গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে।
(a) গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক (Melting Point and Boiling Point):
যে যৌগে আয়নিক বন্ধন থাকে সেই যৌগকে আয়নিক যৌগ বলা হয় এবং যে যৌগে সমযোজী বন্ধন থাকে সেই যৌগকে সমযোজী যৌগ বলা হয়। আয়নিক যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অনেক বেশি হয় কিন্তু সমযোজী যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক আয়নিক যৌগ অপেক্ষা কম হয়। কিন্তু কেন? এটি আসলেই সত্যি আয়নিক যৌগে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান থাকে। এ আধানদ্বয় পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে। আয়নিক যৌগে এরূপ অসংখ্য ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান পরস্পরের কাছাকাছি থেকে ত্রিমাত্রিকভাবে সুবিন্যস্ত হয়ে একটি স্ফটিক তৈরি করে। এতে তাদের আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল অনেক বেশি হয়। ফলে এদেরকে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে বা গলিয়ে ফেলতে অনেক বেশি তাপ শক্তির প্রয়োজন হয়। কাজেই এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অনেক বেশি হয়। অপর দিকে সমযোজী অণুসমূহের মধ্যে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ মূলত দুর্বল ভ্যান্ডারওয়ালস বলের কারণে হয়ে থাকে। কাজেই সমযোজী যৌগে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল অনেক কম হয়। এজন্য এদেরকে সামান্য তাপ প্রদান করলে এরা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অর্থাৎ এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক কম হয়। একইভাবে তোমরা আয়নিক যৌগ NaCl এর পরিবর্তে CuSO4, NaNO3, KCl, CaCl2 ইত্যাদি ব্যবহার করলেও একই বিষয় দেখবে। অন্যদিকে সমযোজী যৌগ হিসেবে গ্লুকোজ, চিনি ইত্যাদি ব্যবহার করে পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করতে পারো। স্ফুটনাঙ্কের ক্ষেত্রে সমযোজী যৌগ হিসেবে আমাদের অতি পরিচিত পানি ব্যবহার করা যায়। সব পরীক্ষাতেই দেখতে পাবে আয়নিক যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক সমযোজী যৌগ থেকে অনেক বেশি।
(b) দ্রাব্যতা/ দ্রবণীয়া ( Solubility):
তোমরা একটি বিকার বা কাচের একটি পাত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি নাও। এরপর এতে আয়নিক যৌগ হিসেবে খাদ্য শৰণ (NaCl) যোগ করে নাড়তে থাকো। দেখবে সমস্ত খাদ্য লবণ পানিতে দ্রবীভূত হয়েছে। এরপর কাপড় কাচা সোডা (Na2CO3.10H2O), তুঁতে (CuSO4.5H2O) বা অন্য বেশ কয়েকটি আয়নিক যৌগ নিয়ে একইভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করো, দেখতে পাবে প্রতি ক্ষেত্রে আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হচ্ছে। অর্থাৎ তোমরা বলতে পারো যে, সকল আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় কিন্তু কিছু কিছু আয়নিক যৌগ আছে যেমন: সিলভার ক্লোরাইড পানিতে দ্রবীভূত হয় না। অপরদিকে, সমযোজী যৌগ যেমন: ন্যাপথালিন, সরিষার তেল, কেরোসিন এগুলো নিয়ে একইভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করলে দেখতে পাবে এদের কেউই পানিতে দ্রবীভূত হয়নি। সমযোজী যৌগ সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত হয় তবে কিছু কিছু সমযোজী যৌগ আছে যেমন চিনি, গ্লুকোজ, অ্যালকোহল এগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়। সুতরাং সামগ্রিকভাবে বলা যায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল সমযোজী যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় না।
অধিকাংশ সমযোজী যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয় না—তবে কিছু কিছু সমযোজী যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয়, এর কারণ কী? এর কারণ জানতে হলে প্রথমে পানির বন্ধন গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। তোমরা জানো, পানি একটি সমযোজী যৌগ অর্থাৎ পানির অণুতে একটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু ইলেকট্রন শেয়ারের মাধ্যমে সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু অক্সিজেন পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে অধিক তড়িৎ ঋণাত্মক হওয়ার পানির অণুর সমযোজী বন্ধনীতে ব্যবহৃত ইলেকট্রন দুটি অক্সিজেনের দিকে সামান্য পরিমাণ সরে যায়। যে কারণে অক্সিজেন পরমাণু আংশিক ঋণাত্মক আধান ও হাইড্রোজেন পরমাণু আংশিক ধনাত্মক আধান প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ পানির অণুতে আংশিক ধনাত্মক এবং আংশিক ঋণাত্মক প্রান্ডের সৃষ্টি হয়। এরকম ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানপ্রাপ্ত সমযোজী যৌগকে পোলার সমযোজী যৌগ বলে। সুতরাং পানি একটি পোলার সমযোজী যৌগ এবং দ্রাবক হিসেবে পানি একটি পোলার দ্রাবক। মনে রাখবে, সমযোজী বন্ধনীস্থ ইলেকট্রন যুগলকে কোনো পরমাণু কর্তৃক নিজের দিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাকে উক্ত পরমাণুর তড়িৎ ঋণাত্মকতা বলা হয়। +১ (গ্লাস ডেলটা) ও – (মাইনাস ডেলটা) দিয়ে যথাক্রমে আংশিক ধনাত্মক আধান এবং আংশিক ঋণাত্মক আধানকে বোঝানো হচ্ছে।
পোলার দ্রাবক পানিতে আয়নিক যৌগ যোগ করলে পানির অণুগুলোর ধনাত্মক প্রাপ্ত আয়নিক যৌগের ঋণাত্মক প্ৰাচ্চ বা অ্যানায়নকে আকর্ষণ করে। একইভাবে পানির অণুর ঋণাত্মক প্রাপ্ত আয়নিক যৌগের ধনাত্মক প্রাপ্ত বা ক্যাটায়নকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বলের মান যখন আয়নিক যৌগের অ্যানায়ন ও ক্যাটায়নের মধ্যকার আকর্ষণ বল থেকে বেশি হয় তখন অ্যানায়ন ও ক্যাটায়ন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির অণু দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়। এভাবে আয়নিক যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয়।
Nacl আয়নিক যৌগ তাই Nacl গোলার দ্রাবক H2O তে দ্রবীভূত হয়। মিথানল (CH, OH) পোলার যৌগ তাই CH,OH পোলার দ্রাবক H2O তে দ্রবীভূত হয়। মিথেন (CH.) আয়নিক যৌগও নয় আবার CH, পোলার যৌগও নয়, কাজেই CH, পানিতে দ্রবণীয় হয় না।
অপরদিকে, সমযোজী যৌগে সাধারণত আয়নিক যৌগের মতো ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্ত থাকে না । তাই পানির অণুর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে সমযোজী যৌগের কোনো আকর্ষণ বা বিকর্ষণ ঘটে না। ফলস্বরূপ সমযোজী যৌগটি পানিতে আয়ন আকারে ভেঙ্গে যায় না অর্থাৎ সমযোজী যৌগটি পানিতে দ্রবীভূত হয় না ।
তবে কিছু কিছু সমযোজী যৌগ আছে যাদের মধ্যে আংশিক ধনাত্মক এবং আংশিক ঋণাত্মক প্রান্ত দেখা যায় অর্থাৎ পোলারিটি দেখা যায়। যেমন: ইথানল (CH, OH) পোলার যৌগ তাই ইথানল পানিতে দ্রবীভূত হয়।
(c) বিদ্যুৎ পরিবাহিতা (Electrical Conductivity):
একটি বিকারে খাদ্য লবণের (NaCl) জলীয় প্রবণ এবং অন্য একটি বিকারে চিনির জলীয় দ্রবণ নাও। এবার উভয় দ্রবণে ইলেকট্রোড হিসেবে দুটি গ্রাফাইট দণ্ড কিংবা যেকোনো ধাতব দণ্ড ডুবিয়ে দণ্ডদ্বয়ের সাথে ছবিতে দেখানো উপায়ে ব্যাটারি এবং বাব যুক্ত করে বর্তনী পূর্ণ করো। এরপর পর্যবেক্ষণ করো। কী দেখলে? দেখবে যে খাদ্য লবণের দ্রবণযুক্ত বর্তনীতে বাল্ব জ্বলছে কিন্তু চিনির জলীয় দ্রবণযুক্ত বর্তনীতে বাল্ব জ্বলছে না। অর্থাৎ খাদ্য লবঙ্গ বা NaCl এর জলীয় দ্রবণ বিদ্যুৎ পরিবহন করে কিন্তু চিনির জলীয় প্রবন বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। এ থেকে তোমরা মন্তব্য করতে পারবে যে, আয়নিক যৌগ জলীয় শ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে কিন্তু সমযোজী যৌগ জলীয় দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। কিন্তু এর কারণ কী? এর কারণ তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো। বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য প্রয়োজন বিচ্ছিন্ন ধনাত্মক বা ঋণাত্মক আয়ন। খাদ্য লবণের (NaCl) জলীয় দ্রবণে ধনাত্মক আয়ন হিসেবে Na+ ও ঋণাত্মক আয়ন হিসেবে Cl- বিদ্যুৎ পরিবহন করে।
যেহেতু জলীয় দ্রবণে আয়নিক যৌগসমূহ বিচ্ছিন্ন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন হিসেবে অবস্থান করে কাজেই সকল আয়নিক যৌগ জলীয় দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে।
অপরদিকে জলীয় দ্রবণে সমযোজী যৌগ বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। কারণ সমযোজী যৌগ কোনো বিচ্ছিন্ন আয়ন তৈরি করে না। আর দ্রবণে আয়ন না থাকলে তা কখনই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারবে না।
CaCl2 কৰণে Ca2+ Cl- থাকে। HCl सৰণে H+ Cl- থাকে। কাজেই এরা সবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে। গ্লুকোজ (CoH12Oa) দ্রবণে আয়ন আকারে বিভক্ত হয় না, কাজেই গ্লুকোজ দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবহন করে না।
দলীয় কাজ কেলাস গঠন (Formation of Crystals) প্রতিটি দল দুটি করে বিকার নাও। একটি বিকারে খাদ্য লবণ (NaCl) ও অপর বিকারে খানিকটা চিনি (C12H22O11) নাও। এই বিকার দুটির মধ্যে পানি যোগ করো। অল্প তাপ দিয়ে যতটুকু সম্ভব লবণ এবং চিনি পানিতে দ্রবীভূত করো। এবার প্রত্যেকটি দ্রবণের মাঝখানে একটা করে সুভা বুলিয়ে কয়েক দিনের জন্য রেখে দাও। তারপর সুতাগুলো তুলে দেখো তার উপর লবণ এবং চিনির ক্রিস্টাল বা কেলাস জমা হয়েছে। সাধারণত সকল আয়নিক যৌগ কেলাস আকারে থাকে। অপরদিকে, কিছু কিছু সমযোজী যৌগ যেমন চিনি কেলাস তৈরি করে তবে, বেশির ভাগ সমযোজী যৌগ কেলাস তৈরি করে না। |
ইতোপূর্বে তোমরা আয়নিক বন্ধন ও সমযোজী বন্ধন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছো। তোমরা দেখেছো যে একটি ধাতু অপর একটি অধাতুর মধ্যে আয়নিক বন্ধন এবং দুটি অধাতব পরমাণুর মধ্যে সমযোজী বন্ধন গঠিত হয়। কিন্তু দুটি ধাতব পরমাণু কাছাকাছি এলে তাদের মধ্যে যে বন্ধন গঠিত হয় সেটাকে ধাতব বন্ধন বলে৷ অর্থাৎ এক খন্ড ধাতুর মধ্যে পরমাণুসমূহ যে আকর্ষণের মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকেই ধাতব বন্ধন বলে। তোমরা তামার (কপার) তার, লোহার (আয়রন) তৈরি ছুরি, কাঁচি, দা কিংবা জানালার প্রিল, অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি জানালা, সোনার অলংকার ইত্যাদি দেখেছো। এসবের মধ্যে একই ধাতুর অসংখ্য পরমাণু পরস্পরের সাথে ধাতব বন্ধনের মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে।
প্রশ্ন হলো ধাতব বন্ধন কীভাবে তৈরি হয়? প্রত্যেক ধাতব পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাধারণত 1টি, ২টি কিংবা গুটি ইলেকট্রন থাকে এবং এদের আকার একই পর্যায়ের অধাতব পরমাণুর চেয়ে বড় হওয়ায় খাত পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনের প্রতি নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ অনেক কম হয়। ফলে ধাতুতে পরমাণুসমূহ তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রনকে ত্যাগ করে ধনাত্মক আরনে পরিণত হয়। এই ধনাত্মক আয়নকে পারমাণবিক শাঁস (Atomic core ) বলা হয়।
ধাতব স্ফটিকে পারমাণবিক শাঁসগুলো সুনির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিকভাবে বিন্যস্ত থাকে। আর ধাতব পরমাণু কর্তৃক ত্যাগকৃত ইলেকট্রনগুলো উন্তু পারমাণবিক শাঁসের মধ্যবর্তী স্থানে যুক্তভাবে ঘোরাফেরা করে। এই ধরনের ইলেকট্রনকে সঞ্চরণশীল (Delocalized Electron) ইলেকট্রন বলে। এই ইলেকট্রনগুলো কোনো নির্দিষ্ট পরমাণুর অধীনে থাকে না পুরো ধাতব খণ্ডের সবগুলো ধাতব আয়নের ইলেকট্রন হয়ে যায়।
বলা যেতে পারে ইলেকট্রনের সাগরে পারমাণবিক ধাতব আয়নগুলো স্ফটিকের আকারে সুবিন্যস্তভাবে সজ্জিত থাকে। ধাতব স্ফটিকে দুটো ধাতব আরনের মধ্যবর্তী স্থানে যখন একটি সঞ্চরণশীল ইলেকট্রন অবস্থান করে তখন ইলেকট্রনের প্রতি উভয় ধাতব আরনই স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণে আকৰ্ষিত হয়। এ কারণে ধাতব আয়ন দুটি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। এটিই মূলত ধাতব বন্ধনের মূল কারণ। ধাতুর মধ্যে সঞ্চরণশীল এই ইলেকট্রনগুলোই তাপ এবং বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য দায়ী। অনুরূপে ধাতুর নমনীয়, ঘাতসহতা ধাতৰ ঔজ্জ্বল্য ইত্যাদি ধর্ম সঞ্চরণশীল এই ইলেকট্রনের কারণেই ঘটে থাকে।
ধাতুর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা
সকল ধাতুই বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। ধাতুর স্ফটিকে মুক্তভাবে বিচরণশীল ইলেকট্রনগুলো বিদ্যুৎ পরিবহনের কাজটি করে থাকে। একটি ধাতব খণ্ডের দুই প্রান্তের সাথে ব্যাটারির ধনাত্মক (+) ও ঋণাত্মক (-) প্রান্ড সংযুক্ত করলে ইলেকট্রনগুলো ঋণাত্মক প্রান্ত থেকে ধনাত্মক প্রান্তের দিকে প্রবাহিত হবে। অর্থাৎ ধনাত্মক প্রাঙ্ক থেকে ঋণাত্মক প্রান্তের দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে। সঞ্চরণশীল ইলেকট্রন না থাকলে ধাতুর মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতো না।
ধাতুর তাপ পরিবাহিতা
আবার, এক খন্ড খাতব পাতের এক প্রান্তকে আগুনের উপর রেখে উত্তপ্ত করলে দেখতে পাবে অপর প্রান্তটি বেশ তাড়াতাড়ি গরম হতে শুরু করেছে। এর অর্থ ধাতুগুলো তাপ পরিবাহিতাও প্রদর্শন করে। এর কারণও সঞ্চরণশীল ইলেকট্রন। তাপ প্রদানের সাথে সাথে সঞ্চরণশীল ইলেকট্রনগুলো শতি গ্রহণ করে এবং তাদের গতিবেগ বেড়ে যায় এবং ইলেকট্রনগুলো অধিক তাপমাত্রার প্রান্ত থেকে কম তাপমাত্রার গ্রাম্ফের দিকে স্থানান্তরিত হয়। এর ফলে ধাতুতে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে তাপের পরিবহন ঘটে।
স্থানীয়ভাবে সহজপ্রাপ্য দ্রব্যের মধ্যে আয়নিক ও সমযোজী যৌগ শনাক্তকরণ। খাদ্য লবণ, কর্পূর, ন্যাপথলিন কাপড়কাচা সোডা এগুলোকে আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিকারে রক্ষিত পানির মধ্যে নিয়ে কাচ দণ্ড দিয়ে ভালোভাবে মিশাও। যেগুলো পানিতে দ্রবীভূত হলো সেগুলো আয়নিক যৌগ আর যেগুলো পানিতে দ্রবীভূত হলো না সেগুলোতে সমযোজী যৌগ। এভাবে অন্য যৌগগুলোকেও পানিতে তাদের দ্রবণীয়তার উপর ভিত্তি করে আয়নিক ও সমযোজী এ দুইভাগে ভাগ করা যায়। |
Read more